সাইনোসাইটিস এর কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

by Dr. Baby Akter
সাইনোসাইটিস-এর-কারণ-লক্ষণ-ও-চিকিৎসা

মানুষের নাকের আশপাশে  প্রায় আটটি সাইনাস থাকে। ম্যাক্সিলারি সাইনাস, স্পেনয়েড সাইনাস, ইথময়েড সাইনাস এবং ফ্রন্টাল সাইনাস নামে নাকের দুই পাশে দুটি করে সাইনাস থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে ম্যাক্সিলারি সাইনাস। যদি কোনো কারণে সাইনাসের কোষগুলোতে কোনো প্রকার প্রদাহ হয় বা ফোলে যায়, তখন এটাকে সাইনোসাইটিস বলে। নাকের আশপাশের এই হাঁড়গুলোর ভেতরে কিছু গহ্বর বা কুঠুরি রয়েছে, যা বাতাসে পূর্ণ থাকে। প্রধানত শরীরে বাতাস চলাচলে সাহায্য করে থাকে এই অঙ্গটি। যখন ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, ভাইরাস সংক্রমণ, ছত্রাক (ফাঙ্গাল) সংক্রমণ এবং অ্যালার্জির কারনে প্রকোষ্টগুলির ভিতরের আস্তরণকারী টিস্যুতে প্রদাহের সৃষ্টি হয়, টিস্যু গুলি ফুলে যায় তখন সাইনোসাইটিসের সমস্যা সৃষ্টি হয়।

প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম—কথাটি সাইনোসাইটিসের ক্ষেত্রে অনেকটাই প্রযোজ্য। একটু সচেতন হলে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

বিভিন্ন প্রকার সাইনোসাইটিস

সময়ের ওপর নির্ভর করে প্রদাহ কতক্ষণ স্থায়ী হচ্ছে সেটির ওপর নির্ধারণ হয় (তীব্র, সাব-একিউট, দীর্ঘস্থায়ী বা পুনরাবৃত্ত-তীব্র) এবং কি কি  কারণে (ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাক সংক্রমন) প্রদাহের সৃষ্টি হয়েছে সেই অনুসারে সাইনোসাইটিস কে বিভিন্ন প্রকারে ভাগ করা হয়। 

  • অ্যাকিউট সাইনোসাইটিস : এর উপসর্গগুলো সাধারণত ২-৪ সপ্তাহ থাকে।
  • সাব-একিউট সাইনোসাইটিস : এ ক্ষেত্রে উপসর্গগুলো ৪-১২ সপ্তাহ থাকে।
  • ক্রনিক সাইনোসাইটিস : লক্ষণগুলি কমপক্ষে ১২ সপ্তাহ স্থায়ী হয়। সাধারণত ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে ঘটে। পুনরাবৃত্ত-তীব্র সাইনোসাইটিসের লক্ষণ গুলি এক বছরে ৪ বা তার বেশি বার ফিরে আসে। সাধারণত প্রতিবার ২ সপ্তাহের কম সময়ের জন্য স্থায়ী হয়।

সাইনোসাইটিসের কারণ সমূহ

বিভিন্ন কারনে সাইনাসের প্রকোষ্ঠ গুলিতে তরল (মিউকাস) পদার্থ জমে এবং প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। নাকের ভেতরের শিরা (ভেইন), মিউকাস মেমব্রেন ফুলে গিয়ে নাকের ভেতরে ব্লক তৈরি করে। এর একটি অ্যালার্জিক রাইনাইটিস। সাধারণত নাকের মিউকাস মেমব্রেনের প্রদাহ ও ফুলে যাওয়াকেই রাইনাইটিস বলা হয়। 

তাছাড়া আরো কিছু কারণ রয়েছে যেমন :

  • ভাইরাস সংক্রমণ , ছত্রাক সংক্রমণ ,সাইনাস প্রকোষ্ঠে অ্যালার্জি ,সাধারণ সর্দি ইনফ্লুয়েঞ্জা এর কারণে। 
  • ঠান্ডাজনিত সাইনোসাইটিস হতে পারে।
  • মরাক্সেলা ক্যাটারেলিস ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ । 
  • স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনিয়া ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ । 
  • কারও নাকে যদি মাংস বেড়ে যায়, পলিপ থাকে কিংবা নাকের হাড় বাঁকা থাকে, তাদের সাইনাসের সমস্যা হতে পারে।
  • হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ।
  • টনসিলাইটিস ও এডিনয়েডে সংক্রমণও একটি কারণ

সাইনোসাইটিসের লক্ষণ ও উপসর্গ

  • নাক থেকে ঘন, বিবর্ণ স্রাব (নাক দিয়ে জল পড়া), নাকের প্রদাহ , নাক দিয়ে শ্বাস নিতে অসুবিধা। 
  • গলায় শ্লেষ্মা জমা হওয়া (পোস্টনাসাল ড্রিপ), কাশি।
  • মাথার সামনের অংশে ব্যথা। মুখে ব্যথা, মাথা ভার ভার অনুভব হওয়া।
  • ঘ্রাণশক্তি কমে যাওয়া, নিশ্বাসের সময় ব্যতিক্রমী ঘ্রাণ পাওয়া। 
  • গন্ধ ও স্বাদের অনুভূতি কমে যাওয়া। 
  • কানের ব্যথা, গলা ব্যথা, উপরের চোয়াল এবং দাঁতে ব্যাথা, নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ। 
  • অনেক সময় এর সঙ্গে জ্বর, গা মেজমেজ করা। মানসিক অবসাদ।

 যাদের সাইনোসাইটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি

যেকোনো বয়সের মানুষেরই সাইনাসের সমস্যা হতে পারে। কিছু কিছু ব্যাক্তির অন্যদের তুলনায় বিভিন্ন কারণে সাইনোসাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কারণগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • নাকের এলার্জি
  • নাকের সেপ্টাম টিস্যুতে চ্যুতি 
  • যাঁদের সাধারণ ঠান্ডাজনিত সমস্যা আছে বা সাইনাসে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন।
  • হাঁপানি/অ্যাজমা রোগী।
  • ছত্রাক সংক্রমণ ,ভাইরাস সংক্রমণ ,সাইনাস প্রকোষ্ঠে অ্যালার্জি , ইনফ্লুয়েঞ্জা, সাধারণ সর্দি । 
  • হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ।
  • স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনিয়া ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ।
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম বা দুর্বল ইমিউনিটি।
  • মাদকদ্রব্য গ্রহণ ও নিয়মিত  ধূমপানের অভ্যাস।
  • ক্যান্সারের বা এইচআইভি কিছু নির্দিষ্ট ওষুধের ব্যবহার করা ।

সাইনোসাইটিসের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

সাইনোসাইটিসের চিকিৎসা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গুলো হলো  —

  • ওভার-দ্য-কাউন্টার (OTC) ঠান্ডা এবং অ্যালার্জি ওষুধ সেবন করতে পারেন।
  • গরম ভাপ বা মেন্থলের ভাপ নিতে পারেন। এর মাধ্যমে দ্রুত শ্লেষ্মা বের হয়ে সাইনাসের সমস্যায় দ্রুত উপশম দেয়।
  • নাসাল ডিকনজেসটেন্ট (জমে যাওয়া নাক পরিস্কার)-এর ব্যবহার।
  • ধুলো–বালি থেকে দূরে থাকুন। ঘন ঘন যেন ঠান্ডা না লেগে যায়, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
  • পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন এবং প্রচুর ভিটামিনযুক্ত খাবার খান। প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খান।
  • প্রচুর পানি পান (হাইড্রেশন) করুন।
  • অ্যারোসোল, মশার কয়েলের ধোঁয়া, এয়ারফ্রেশনারসহ যেকোনো ধরনের ধোঁয়া ও স্প্রে থেকে দূরে থাকুন।
  • ধূমপান থেকে দূরে থাকুন।
  • অ্যালার্জি প্রতিরোধে ব্যবস্থা। ধুলো, ধোঁয়া এবং ফুলের পরাগের সংস্পর্শ এড়ানো।
  • অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস (যেমন নাকের ভিতরে আঙ্গুল) না দেওয়া। 
  • স্যালাইন (লবণাক্ত পানি) দিয়ে নাক ধোয়া দেয়া। 
  • সাইনাসের সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেয়ে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
  • নাকের গঠনগত সমস্যার চিকিৎসার জন্য অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। 
  • প্রাথমিক চিকিৎসা কিংবা ওষুধের মাধ্যমে প্রতিকার না পেলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে পরবর্তী পদক্ষেপ নিন। 

সাইনোসাইটিস এর ঘরোয়া চিকিৎসা

সাইনোসাইটিস এর ঘরোয়া চিকিৎসাজন্য যা যা করা যায় –

  • সাইনোসাইটিস সমস্যায় গরম পানির ভাপ বা সেঁক নেওয়া একটি অত্যন্ত কার্যকর পদ্ধতি। গরম পানির ভাপ নিলে নাসিকা-পথ ভেজা থাকবে এবং সহজেই শ্লেষ্মা বের হয়ে আসবে। তাই গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে নিয়ে দিনে দু-বার করে ভাপ নিন।
  • গরম পানিতে আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে পান করুন এতে সাইনাসের ব্যথা থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়। 
  • পানি গরম করার সময় পুদিনা পাতা মিশিয়ে বাষ্প গ্রহণ করলে সাইনাসজনিত ব্যথা এবং জ্বালা থেকে মুক্তি পাবেন দ্রুত।
  • ঠান্ডা লাগলে কিংবা মাথা ব্যথা করলে এক বাটি গরম স্যুপ আহার করুণ। আপনার পছন্দ অনুসারে যেকোনো স্যুপ খেতে পারেন।
  • কাঁচা সবজির জুস সাইনোসাইটিসের প্রভাব কমানোর জন্য অনেক উপকারী। 
  • আদা অথবা দারুচিনির চা হালকা গরম অবস্থায় পান করুন।
  • পেঁয়াজ এবং আদার গন্ধ শুঁকলে অনেক উপকার পাওয়া যায়। এই দুটি উপাদানের অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি গুণ আছে।
  • ১০০ গ্রাম জিরা টেলে ২০০ গ্রাম ঘি এর সাথে মিশিয়ে প্রতিদিন সেবন করুন। এটি সাইনোসাইটিস প্রতিরোধের অন্যতম উপায়।

You may also like

Leave a Comment