মহিলাদের পাইলস বা অর্শ্বরোগের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

by Dr. Baby Akter
মহিলাদের পাইলস বা অর্শ্বরোগ

পাইলস বা অর্শ্বরোগে মলদ্বার বা মলদ্বারের নীচের অংশের রক্তনালীগুলি ও পায়ূ টিস্যুগুলির উপর কোন কারণে জটিলতা সৃষ্টি হলে মলদ্বার অঞ্চলের চারপাশে চাপ বৃদ্ধি পায় ফলে তা প্রসারিত হয়ে ফুলে যায় এতে মলদ্বারে ব্যথা, চুলকানি, রক্তপাত এবং জ্বালা সৃষ্টি করে। এতে রোগী অধিক যন্ত্রনা ও অস্বস্তি অনুভব করে। 

প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে পাইলসের বা অর্শ্বরোগের সম্ভাবনা রয়েছে তা অবস্থার তীব্রতার উপর নির্ণয় করা হয়। তবে গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে পেলভিক রক্ত ​​প্রবাহ এবং চাপের কারণে অস্বস্তি, চুলকানি, ব্যথার জটিলতা বাড়তে পারে। সাধারণত গর্ভবতী মহিলাদের পাইলসের সমস্যা বেশি দেখা দিলেও ৪০ ঊর্ধ্বে মহিলাদের পাইলসের জটিলতা বেশী দেখা যায়। তাই মহিলাদের পাইলসের সমস্যার ক্ষেত্রে সচেতনতা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। 

যেহেতু দীর্ঘদিনের কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্রনিক ডায়রিয়া এবং মলদ্বারে অতিরিক্ত চাপ পাইলসের অন্যতম কারণ। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, জীবনযাত্রা এবং খাদ্যাভাসের পরিবর্তন আনা পাইলস নিয়ন্ত্রণের প্রথম শর্ত

মহিলাদের পাইলসের সমস্যা বা পাইলস রোগ দুই ধরণের হয় থাকে:

  • ইন্টারনাল পাইলস (Internal Hemorrhoids)
  • এক্সটার্নাল পাইলস (External Hemorrhoids)

মহিলাদের ইন্টারনাল পাইলস (Internal Hemorrhoids)

ভিতরের পাইলস (Internal hemorrhoids) এর ক্ষেত্রে লক্ষণ বা হেমোরয়েডগুলি মলদ্বারের মধ্যে থাকে সাধারণত দেখা যায় না। প্রায়শই ব্যথাহীন হয়, তবে মলত্যাগের সময় স্ট্রেন, রক্তপাত এবং জ্বালা সৃষ্টি করতে পারে। 

মহিলাদের এক্সটার্নাল পাইলস (External Hemorrhoids)

মলদ্বারের বাইরের সমস্যাগুলোকে এক্সটার্নাল পাইলস বলা হয়। মলদ্বারের বাইরে অবস্থিত শিরাগুলির উপর চাপ সৃষ্টির ফলে শিরা ফুলে যাওয়া, রক্তপাত, ফাটল এবং চুলকানি হতে পারে। অনেক সময় রক্ত ​​জমাটও বাঁধতে পারে। এই বাহ্যিক হেমোরয়েডগুলি তীব্র ব্যথা, অস্বস্তি এবং ফোলাভাব সৃষ্টি করে যার কারণে এক্সটার্নাল বা বাইরের পাইলস অধিক যন্ত্রণাদায়ক হয়।  

মহিলাদের পাইলস বা আর্শ্বরোগের বিভিন্ন উপসর্গ অনুযায়ী  চারটি আলাদা (grades)গ্রেডে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে :

Grade 1

এই ধরনের পাইলস বা অর্শ্বরোগ মলদ্বারের ভিতরে থাকে। এগুলি সাধারণত ছোট হয় এবং কম ব্যথা বা প্রদাহ সৃষ্টি করে, প্রায়শই ব্যথাহীন থাকে। মহিলাদের মধ্যে এই ধরনের পাইলসের উপসর্গগুলিতে মলত্যাগের পরে সামান্য পরিমাণে রক্ত ​​দেখা যেতে পারে।

Grade 2

এটি গ্রেড 1-এর তুলনায় ফোলা বেশি প্রকট হয়ে থেকে পায়ুপথ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মলত্যাগের সময়, ফোলাটি বাইরের দিকে বেরিয়ে আসে যদিও তা মলত্যাগের পর ঢুকে যায়। 

Grade 3

এই গ্রেডে মলদ্বারের ভিতরে ফুলে যায়, যা মলত্যাগের সময় বাইরে চলে আসে দেখতে অনেকটা মাংস পিণ্ড এর মত হয়। এবং এটি  মলত্যাগের আঙ্গুলের ডগা ব্যবহার করে ভিতরে ঢুকিয়ে দিতে হয় বা ম্যানুয়াল রিপজিশনিং প্রয়োজন হয়। 

Grade 4

এই গ্রেডে পাইলসের সমস্যা সবচেয়ে ক্ষতিকর পর্যায়ে থাকে। যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাইরের দিকে ফুলে যায় এবং মলদ্বার থেকে বেরিয়ে আসে। এই অবস্থার সাথে রক্তপাত হতে পারে বা নাও হতে পারে এবং যদি জমাট বাঁধা হয় বা পায়ুপথে পাইলস বা অর্শ্বরোগ সংকুচিত হয়ে যায় তাহলে ব্যথা হতে পারে।

প্রল্যাপস পাইলস (Prolapse piles)

প্রল্যাপস পাইলস এর ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক হেমোরয়েডগুলি ফুলে গিয়ে মলদ্বারের বাইরে বেরিয়ে আসে। এর ফলে রোগীর প্রচন্ড অস্বস্তি হয় এবং রক্তপাতও হয়ে থাকে। 

মহিলাদের পাইলসের বা আর্শ্বরোগের লক্ষণসমূহ –

সাধারণত ৪০% পাইলসের রোগী কোন ব্যথাহীন এবং উপসর্গহীন অবস্থায় থাকে, আর বাকি ৬০% মহিলাদের মধ্যে পাইলসের বিভিন্ন লক্ষণ গুলো দেখা যায় যেমন –

  • মলদ্বারে ব্যথা, প্রদাহ, চুলকানি এবং অস্বস্তি।
  • মলদ্বারে ক্রমাগত পিণ্ডের মতো ফোলাভাব।
  • রক্তের মিশ্ৰিত মলত্যাগ করা।

মহিলাদের মধ্যে পাইলসের এই প্রাথমিক উপসর্গগুলি তুলনামূলকভাবে হালকা হয় তবে প্রাথমিক অবস্থা থেকে একজন ডাক্তারের পরামর্শে অনুসারে চিকিৎসা শুরু করা উচিত। অবস্থার অবনতি হলে লক্ষণগুলি তীব্র হতে পারে যেমনঃ 

  • মলদ্বারের চারপাশে সর্বদা ব্যথা, বসতে খুব অস্বস্তি লাগে।
  • মলত্যাগের সময় উজ্জ্বল লাল রক্ত বের হয়।
  • মলদ্বার ভিতরে এবং বাইরে মলদ্বারের চারপাশে চুলকানি থাকে।
  • শ্লেষ্মা স্রাব, অন্তর্বাসে দাগ দেখা যায়।
  • টয়লেট ব্যবহারের পরেও মলত্যাগের প্রয়োজন অনুভব হয়।

মহিলাদের পাইলসের বা আর্শ্বরোগের  কারণ:

গর্ভাবস্থায়:

গর্ভাবস্থায় মহিলাদের মধ্যে পাইলস সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, যখন গর্ভের শিশু ৩৬ সপ্তাহের কাছাকাছি শ্রোণী গহ্বরে (Pelvic Cavity) নেমে আসে, তখন পেলভিক এলাকায় চাপ সৃষ্টি করে। এই চাপ মলদ্বার এবং মলদ্বার রক্তনালীগুলির বৃদ্ধি করে, যা আস্তে আস্তে পাইলসের সমস্যা সৃষ্টি করে। অনেক ক্ষেত্রে প্রসবের পরে তা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে যায়।

কোষ্ঠকাঠিন্য এবং খাদ্যাভাস: 

হরমোনের পরিবর্তনের কারণে গর্ভবতী মহিলারা কোষ্ঠকাঠিন্যে আক্রান্ত হন। খাদ্যাভাস, অপর্যাপ্ত ফাইবার, কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা মলদ্বারে চাপ সৃষ্টি করে এবং ফলে পাইলস রোগ সৃষ্টি হতে শুরু করে ।

দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করা: 

পুরুষ এবং মহিলা উভয়েই কাজের প্রয়োজনে দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করেন। এতে নিতম্বের অংশে  (Hip Area) চাপ সৃষ্টি করে, যার ফলে গ্লুটিয়াল পেশীগুলি (Gluteal Muscles) ছড়িয়ে পড়ে মলদ্বার এবং মলদ্বারের চারপাশে ছোট শিরাগুলি বড় হয়ে বেদনাদায়ক ফোলা তৈরি করে। এর থেকে পাইলসের সমস্যা সৃষ্টি হয়।

ভারী  উত্তোলন:

দৈনন্দিন জীবনে যদি নিয়মিত ভারী কিছু উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত থাকে তাহলে মলদ্বারের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে যার ফলে মলদ্বারের পেশী দুর্বল হয়ে পাইলসের জটিলতা তৈরী করে। 

বার্ধক্যজনিত কারণ:

৫০ বছরের বেশি বয়সী মহিলাদের মধ্যে বার্ধক্যজনিত কারণে পাইলস বা হেমোরয়েড এর সমস্যা বেশি দেখা যায়। দীর্ঘদিনের খাদ্যাভ্যাস, স্বাস্থ্য অচসেতনতা, অন্যান্য রোগের জটিলতা থেকে বার্ধক্যজনিত পাইলসের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। 

মহিলাদের পাইলস রোগ নির্ণয়-

সাধারণত মহিলাদের পাইলস রোগ নির্ণয় করার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিৎ- 

  • রোগীর পাইলসের পারিবারিক ইতিহাস
  • মলের সাথে রক্ত বা শ্লেষ্মা উপস্থিতি থাকে কিনা। 
  • সাম্প্রতিক সময়ে রোগীর ওজন হ্রাস পাচ্ছে কিনা। 
  • মলত্যাগে পরিবর্তন হয় কিনা। 

চিকিৎসকরা, অভ্যন্তরীণ (Internal Hemorrhoids) পাইলসের জন্য, একটি ডিজিটাল রেকটাল পরীক্ষা (DRE) বা একটি প্রক্টোস্কোপ ব্যবহার থাকেন। তবে প্রয়োজন অনুসারে, মলদ্বারের ভিতর থেকে টিস্যুর নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে থাকেন। এই ক্ষেত্রে পাইলসের লক্ষণ ও উপসর্গ পাচনতন্ত্রের (Digestive System) সমস্যা বা কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের ঝুঁকি রয়েছে কিনা সেটিও নির্ণয় করা যায়। 

মহিলাদের পাইলস রোগের চিকিৎসা –

মহিলাদের মধ্যে পাইলসের বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। তবে পাইলসের বেশ কিছু সমস্যা লাইফস্টাইল এবং খাদ্যাভাস পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাধান করা যায়। 

যেহেতু মলত্যাগের সময় কোষ্ঠকাঠিন্য এবং স্ট্রেনিং পাইলসের অন্যতম কারণ। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, জীবনধারায় পরিবর্তন আনা পাইলসের সমস্যা সমাধানের প্রথম শর্ত। মলত্যাগের সময় কোষ্ঠকাঠিন্য এবং স্ট্রেনিং পাইলসের অধিক জটিলতা সৃষ্টি করে, তাই খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন আনাও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ফল, শাকসবজি এবং সকালের নাস্তায় ব্রান-ভিত্তিক সিরিয়াল, উচ্চ ফাইবার যুক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে মলকে সহজ ও নরম করে যা অতিরিক্ত চাপ বা স্ট্রেনিং কমায়। পর্যাপ্ত হাইড্রেশন এবং স্বাস্থ্যকর খাবার শরীরের সঠিক  ওজন বজায় রাখে ফলে পাইলস প্রতিরোধ ও প্রতিকারে করা সহজ হয়। 

হোমিওপ্যাথিক  চিকিৎসা –

প্রদাহ, ব্যথা এবং চুলকানি ব্যথা ও অস্বস্তি  লক্ষণ অনুসারে হোমিও মেডিসিন নির্ধারণ করা যায়। তবে রোগের স্থায়ী সমাধান পাওয়ার জন্য অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসকের পরামর্শে নিতে হবে। দীর্ঘদিন অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে তা মারাত্বক আকার ধারণ করে। এতে অপারেশন বা সার্জারীর প্রয়োজন পড়ে। 

লক্ষণ অনুসারে সাধারনত পাইলসের হোমিও মেডিসিন গুলো হল-

হ্যামেলিস (Hamelis)-

মহিলাদের পাইলসের রক্তপাত বন্ধ করতে ওষুধটি খুব উপকারী। হ্যামেলিস যে কোনও শিরাস্থ রক্তপাত নিরাময় করতে পারে। এছাড়াও রোগীর পাইলসের ব্যথায় ক্ষেত্রেও এটি সেবনে ভালো কাজ করে।

রতনহিয়া (Ratanhiya)-

এটি পাইলসের ব্যথা থেকে মুক্তির জন্য দারুণ ফল দেয়। পাইলস রোগে আক্রান্ত রোগী মল ছাড়ার সময় এবং এমনকি তার কয়েক ঘণ্টা পরও প্রচণ্ড ব্যথা এবং জ্বালাপোড়া অনুভব করেন। সেক্ষেত্রে রতনহিয়া খুব কার্যকরী। 

গ্রাফাইটস (Graphites)-

এটি কোষ্ঠকাঠিন্য এবং পাইলস উভয়ই ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। যাদের শরীর স্থূল, ত্বক ফাটা এবং কোষ্ঠকাঠিন্য রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে গ্রাফাইটস অতি দ্রুত কাজ করে।

নাক্স ভমিকা (Nux Vomica)-

যারা দীর্ঘক্ষন বসে কাজ করে, অগোছালো, অলস জীবনযাপন করে, ভাজাপোড়া, মশলাদার খাবার, ফাস্টফুড গ্রহণ এবং অতিমাত্রায়  ধূমপায়ী এবং অ্যালকোহল পান করে তাদের পাইলসের সমস্যায় Nux Vomica একটি উপযুক্ত মেডিসিন। এটি রোগীর পাইলসের সমস্যার পাশাপাশি গ্যাস্টিকের ও হজমের জন্য ভালো কাজ করে। 

তবে একজন সিনিয়র হোমিও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে চিকিৎসা নিলে সবচেয়ে উত্তম ফলাফল পাওয়া যাবে। 

মহিলাদের পাইলস দূর করার প্রাকৃতিক উপায় – 

দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন এনে প্রাকৃতিক ভাবে মহিলাদের পাইলসের বেশির ভাগ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। যেমন-

  • আপনার খাদ্যতালিকায় উচ্চ ফাইভের যুক্ত খাবার, প্রচুর ফলমূল এবং তরল বা পানীয় রাখুন।
  • অতিরিক্ত ভাজা পোড়া, বেশি মসলাদার খাবার ও ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলুন। 
  • নিয়মিত ব্যায়াম করুন। 
  • গর্ভবস্থায় সচেতন থাকুন। 
  • জোলাপ এড়িয়ে চলুন।
  • ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে গরম পানির টবে বসুন।
  • দীর্ঘক্ষণ বসে থাকবেন না এবং ভারী কিছু উত্তোলন থেকে বিরত থাকুন।
  • প্রচুর পরিমানে পানি পান করুন। 

Leave a Comment