ডেঙ্গু জ্বর কারণ, লক্ষণ, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা

by Dr. Baby Akter
ডেঙ্গু-জ্বর-কারণ-লক্ষণ-রোগ-নির্ণয়-ও-চিকিৎসা

সম্প্রতি বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রভাব উদ্বেগজনক হরে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রধানত প্রাক-গ্রীষ্ম এবং বর্ষা সময়ে এই রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। ডেঙ্গু সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি থাকে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত যায়। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটে। সময় এবং অঞ্চল-বিশেষে এই রোগ মহামারির আকারও ধারণ করে। বিনা চিকিৎসায়, ভুল চিকিৎসায়, এবং দেরিতে চিকিৎসার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়। তাই অনতিবিলম্বে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ, নির্ণয়, চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া আবশ্যক।

আপনার আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখলে এবং ছোট ছোট কিছু বিষয়ে সচেতন থাকলে ডেঙ্গুজ্বর থেকে যেমন মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে তেমনি আপনার আশপাশের মানুষরাও থাকবে সুস্থ

ডেঙ্গু কি ?

ডেঙ্গি ভাইরাসে সংক্রমণের ফলে ডেঙ্গু জ্বর হয়। ডেঙ্গু হলো এডিস গোত্রের স্ত্রী মশাবাহিত এক ধরনের ভাইরাস, যা ডেঙ্গি নামে পরিচিত। সংক্রমিত মশার সংস্পর্শে আসা সব বয়সের মানুষই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। এই মশাগুলি গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চলে বেশী জন্মায়, যা এই অঞ্চলে ডেঙ্গু জ্বরকে একটি উল্লেখযোগ্য জনস্বাস্থ্য ঝুকিপুর্ন করে তোলে। কোন আক্রান্ত মানুষ থেকে আরেক মানুষে এই রোগ ছড়ায় না। তবে সংক্রমিত মানুষটিকে কামড়ানোর ফলে আক্রান্ত মশা অন্য মানুষকে কামড়ালে তখন সেই মানুষটি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়।

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ

ডেঙ্গু জ্বর হালকা থেকে গুরুতর  বিভিন্ন ধরণের লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। তার মধ্যে বিশেষ লক্ষন গুলো  হলো :

  • প্রচণ্ড জ্বর
  • বমিভাব
  • তীব্র মাথাব্যথা
  • অনিয়ন্ত্রিত পায়খানা 
  • পেশি ও অস্থিসন্ধিতে গুরুতর ব্যথা
  • ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ (যা ক্ষতের মতো দেখাতে পারে)
  • হালকা রক্তপাত (যেমন নাক ও মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া)।
  • মাথাঘোরা
  • জয়েন্ট এবং মাংস পেশীতে ব্যথা
  • বিরক্তি এবং অস্থিরতা

ডেঙ্গুর গুরুতর মাত্রাগুলোর মধ্যে রয়েছে ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর বা ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম নামে একটি গুরুতর আকারে ধারণ করতে পারে। মানুষের শরীরের রক্তনালীগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তপাত, যে কোন অঙ্গের ক্ষতি এবং শেষ পর্যন্ত রোগীর মৃত্যু হতে পারে।

সাধারণত যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং আগে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল তাদের মধ্যে ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে .

ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা

ডেঙ্গু সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ নেই। ডেঙ্গুর চিকিৎসার বিশেষ কোন ওষুধ বা প্রতিষেধক এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। বিশ্বব্যাপী গবেষক ও বিজ্ঞানীরা ডেঙ্গু জ্বরের নতুন চিকিৎসা এবং প্রতিরোধমূলক কৌশল উদ্ভাবনের দিকে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে এবং ক্লিনিকাল ট্রায়াল চলছে। তবে  তাৎক্ষণিক জ্বর ও ব্যথা উপশমের জন্য ডাক্তাররা টাইলেনল বা প্যারাসিটামল প্রেসক্রাইব করে থাকেন। এছাড়াও ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধের জন্য প্রচুর পরিমাণে তরল পান করা এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম করা উচিত।

ডেঙ্গু জ্বরের তিনটি ধরন বা ক্যাটাগরি আছে—‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’। এ ক্যাটাগরির রোগীরা অনেকটাই । অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগী ‘এ’ ক্যাটাগরির। তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই তারা বাড়িতে বিশ্রাম এবং পারিবারিক পরিচর্যার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।

বি ক্যাটাগরির ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে যাদের অন্তঃসত্ত্বা, ডায়াবেটিস,  জন্মগত সমস্যা, স্থূলতা,বমি,পেটে ব্যথা, কিডনি বা লিভারের সমস্যা রয়েছে তাদের হাসপাতালের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। তবে সি ক্যাটাগরির ডেঙ্গু জ্বর অত্যন্ত বিপদজনক।  এতে ,মস্তিষ্ক ,কিডনি, লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে রোগীকে অতি দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে নিবিড় পরিচর্যা অথবা আইসিইউতে রাখতে হবে.

ডেঙ্গু জ্বরের ঘরোয়া  চিকিৎসা

  • পর্যাপ্ত বিশ্রামে থাকতে হবে।
  • ভিটামিন সি (সাইট্রাস ফল, বেরি এবং শাক-সবজিতে পাওয়া যায়)।
  • প্রচুর তরলজাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। লেবুর শরবত, ডাবের পানি, ফলের জুস এবং একটু পরপর খাবার স্যালাইন পান করুন।
  • ডেঙ্গু জ্বর অনুভব হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে। প্রাপ্তবয়স্ক এবং স্বাভাবিক ওজনের একজন ব্যক্তি প্রতিদিন সর্বোচ্চ আটটি প্যারাসিটামল খেতে পারবে। যদি কোনো ব্যক্তির যদি লিভার, হার্ট এবং কিডনি–সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরণের জটিলতা থাকে, তাহলে প্যারাসিটামল সেবনের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
  • আয়রন (মাংস, মটরশুঁটিতে পাওয়া যায়),পেঁপে, ওটমিল (সহজপাচ্য কার্বোহাইড্রেট এবং ফাইবারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ) ইত্যাদি খাবারের কিছু পুষ্টি উপাদান ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের জন্য বিশেষ ভাবে উপকারী হতে পারে।
  • ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে গায়ে ব্যথার জন্য ক্লোফেনাক,অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন–জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গুর সময় এ–জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করলে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
  • পেয়ারাতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে,যা ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করবে। এক কাপ পেয়ারার রস দিনে ২ বার পান করা যেতে পারে। অথবা তাজা পেয়ারা খেলেও ভালো প্রতিকার পাওয়া যায়।
  • এক কাপ গরম পানিতে কিছু মেথির বীজ ভিজিয়ে রেখে তা ঠান্ডা করে দিনে ২ বার করে পান করলে জ্বর কমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে উপকার পাওয়া যায়.ভিটামিন সি, কে এবং ফাইবার সমৃদ্ধ মেথির পানি স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। 
  • প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসে লেবু, কমলা, জাম্বুরার মত সাইট্রাস জাতীয় ফল, রসুন, বাদাম, এবং হলুদ রাখা যেতে পারে। এতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী থাকলে ডেঙ্গু থেকে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

ডেঙ্গু জ্বরের প্রতিরোধ, প্রতিকার এবং করণীয়

এই রোগ প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায় হলো সংক্রামিত মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা। এর জন্য মশার বংশ বিস্তারের সব রকম পরিবেশ সমূলে ধ্বংস করতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায়গুলো হলো-

  • বাড়ির চারপাশে জল জমতে দেবেন না। জমা জলে মশারা বংশবিস্তার করে। জল জমতে না দিয়ে মশার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সপ্তাহে অন্তত একবার জল জমতে পারে এমন জায়গা পর্যবেক্ষণ করুন। এবং গাছের টব, ফুলদানি, পরে থাকা গাড়ির টায়ারের জমে থাকা জল ফেলে দিন। 
  •  সন্ধ্যার আগে আগেই জানালা ও দরজা লাগিয়ে দেয়া। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকলে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা।
  • ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী মশা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। এই সময় অতিরিক্ত সতর্ক থাকুন। 
  • বাড়ির বাইরে যাওয়ার সময় মশা নিধনে ব্যবহৃত ক্রিম রাখতে পারেন সঙ্গে।

Leave a Comment