শীতকালীন বিভিন্ন রোগ এবং প্রাকৃতিক প্রতিকার

by Dr. Baby Akter
শীতকালীন বিভিন্ন রোগ এবং প্রাকৃতিক প্রতিকার

আবহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষ নানা অসুখে আক্রান্ত হয়। ঠিক তেমনি শীতকালে কিছু কিছু রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। যেমন সর্দি-জ্বর, কাশি-হাঁচি ও শ্বাসকষ্ট ডায়রিয়া, খুশকি, খোসপাঁচড়া বা চর্মরোগ প্রভৃতি। এ সময় কারো ঠান্ডাজনিত সমস্যা হলে তা সহজে না সারার প্রবণতা থাকে। ঠাণ্ডার কারণে অনেকের টনসিল বেড়ে গিয়ে ব্যথার সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে। তাই তীব্র শীত আসার আগেই কিছু রোগের প্রকোপ ঠেকাতে সতর্ক থাকা ভালো।

শীতে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার বেশী খান। পানি শরীরকে হাইড্রেট রাখে এবং ভিটামিন সি ঠান্ডা লাগার প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করে ।

শীতের বিভিন্ন রোগ ও প্রতিকার

সর্দি-কাশি-জ্বর

শীতকালে সর্দি-কাশি-জ্বর বা কমন কোল্ড একটি সাধারণ রোগ। ঋতু পরিবর্তনের সময় এ রোগ বেশি দেখা যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের কম তাদের এ রোগ হওয়ার সম্ভবনা বেশী। দেহের শ্বাসনালির এক ধরণের ভাইরাসজনিত সংক্রমনে সর্দিজ্বর হয়ে থাকে। সর্দিজ্বর হলে প্রথমে নাকে ও গলায় অস্বস্তি লাগে, হাঁচি হয়, নাক দিয়ে অনবরত পানি ঝরতে থাকে। মাথা ভারী বোধ হওয়া, মাথাব্যথা, শরীরে ব্যথা, গলাব্যথা, জ্বর, প্রভৃতি উপসর্গও দেখা যায়। নাক বন্ধও থাকতে পারে।

সর্দিজ্বরে আক্রান্ত হলে অন্যদের মেলামেশায় সতর্কতা অবলম্বন করুন। হাঁচি দেওয়ার সময় বা নাকের পানি মুছতে রুমাল বা টিস্যু পেপার ব্যবহার করুন। যেখানে সেখানে কফ, থুথু বা নাকের শ্লেষ্মা ফেলা যাবে না। রোগীর ব্যবহৃত রুমাল বা গামছা অন্যদের ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখুন। দেহকে সতেজ রাখতে এবং রোগ প্রতিরোধে বৃদ্ধি করতে তাজা, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পানি পান করুন।

ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ও ডেঙ্গু

শীতকালে অনেক স্থানে মশার প্রকোপও বাড়ে। আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মশাবাহিত ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, ডেঙ্গু রোগ সহ নানা ভাইরাস জ্বরের রোগের প্রকোপ দেখা যায়। মূলত অ্যাডিনোভাইরাস, রাইনোভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি ভাইরাস জ্বরের জন্য দায়ী। শিশু, বয়স্ক ও যাদের শরীরে অন্য রোগ যেমন- ডায়াবেটিস, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস আছে, তাদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কাঁপুনি দিয়ে উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর আসা, গিঁটে ব্যথা, বারবার জ্বর আসা, ইত্যাদির লক্ষণ দেখা গেলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তাই পর্যাপ্ত বিশ্রাম, ডাবের পানি, প্রচুর তরল জাতীয় খাবার, বিশেষত খাবার স্যালাইন, লেবু-চিনির শরবত এ সময়টায় বেশ উপকারী। ডেঙ্গু বর্ষাকালীন রোগ হলেও এখন শীতকালেও এটির বিস্তার দেখা যায়। তাই মশার কামড়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। 

নিউমোনিয়া

পৃথিবীব্যাপী পাঁচ বছরের নিচের শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া। এটি একটি মারাত্মক অসুখ। বাংলাদেশেও শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণ এ রোগটি। নিউমোনিয়ায় শিশু ও বৃদ্ধরা বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়। যদিও এটি প্রতিরোধযোগ্য এবং চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময়যোগ্য একটি রোগ। লোয়ার রেসপিরেটরি ট্র্যাক সংক্রমণ যা ব্যাকটেরিয়ার কারনেও ভাইরাল নিউমোনিয়াও হতে পারে। শীত উপযোগী হালকা ও নরম গরম কাপড় ব্যবহার করুন। সুস্থ শিশুকে সর্দি-কাশি, ব্রংকিওলাইটিস, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর কাছে যেতে দেবেন না। সুষম ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ান, ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’ গ্রহণ করুন। ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করতে পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন। নিউমোনিয়া রোগীর অবস্থা অবনতি দেখা দিলে দ্রুত হসপিটালে ব্যবস্থা করুন। 

পাতলা পায়খানা

ঠাণ্ডার কারণে শিশুদের বা বড়দেরও হঠাৎ করে পাতলা পায়খানা হতে দেখা যায়। বিশেষ করে যখন বেশি ঠাণ্ডা পড়ে তখন পাতলা পায়খানা সমস্যা বেশি হয়ে থাকে। খাবারের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে, এই সমস্যা এড়াতে বাইরের খাবার একেবারে না খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। বয়স্ক ও শিশুদের গরম কাপড়ের পাশাপাশি সবসময় হাতমোজা ও মোজা পরে থাকতে হবে।

চর্মরোগ

শীতের সময় নানা ধরনের চর্মরোগ হতে পারে। বিশেষ করে ঠোঁট, হাত ও পায়ের ত্বকে দেখা দেয় চুলকানি, একজিমা, স্ক্যাবিস, চর্মরোগ প্রভৃতি। এসময় বাতাসের আর্দ্রতা কম থাকার কারণে শুষ্ক বাতাস ত্বক থেকে শুষে নেয় পানি। ফলে ত্বক হয়ে পড়ে দুর্বল। এ ছাড়া মাথায় প্রচুর খুশকি দেখা যায়। ত্বকের সুরক্ষায় ময়েশ্চারাইজার যেমন: ভ্যাসেলিন, গ্লিসারিন, অলিভ অয়েল ও সরিষার তেল ব্যবহার করুন।  শীতের সময় তাই অলিভ অয়েল বা লুব্রিকেন্টজাতীয় কিছু ব্যবহার করুন। অলিভ অয়েল ত্বকে আলাদা আস্তর তৈরি করে বলে ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। বেশিক্ষণ রোদে থাকলে কড়া আগুনের তাপে চামড়ায় সমস্যা তৈরি হতে পারে। তাই অতিরিক্ত রোদ পোহানো পরিহার করুন। 

বাতব্যথা

বাতের বা আর্থ্রাইটিস সমস্যা শীতে অনেকের বেড়ে যায় মূলত বয়স্কদেরই হয় বেশি। শেষ করে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস (Rheumatoid arthritis) বা এনকাইলোজিং স্পন্ডিওলাইটিস (Ankylosing spondylitis), স্পন্ডাইলো আর্থ্রাইটিস (Spondylarthritis), রি-অ্যাকটিভ আর্থ্রাইটিস, সোরিয়াসিটিস, অস্টিও আর্থ্রাইটিস রোগীদের শীতের সময় চলাফেরা বা মুভমেন্ট কম হয় বলে ব্যথার প্রকোপ বেড়ে যায়। প্রয়োজনে গরম উত্তাপে থাকুন। অতিরিক্ত ওজন থাকলে তা খাদ্যাভাসের মাধ্যমে কমিয়ে আনুন। সবসময় হালকা মুভমেন্ট  করার চেষ্টা করবেন, একটানা অনেকক্ষণ বসে থাকবে না। গরম ছেঁক দিন বা প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ  অনুযায়ী ফিজিওথেরাপি নিন।

অ্যাজমা

অ্যাজমা একবার হলে এর ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হয় সারা জীবনই। হাঁপানি বা অ্যাজমা  শুধু শীতকালীন রোগ নয় ,শ্বাসকষ্টের রোগ। অ্যাজমাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে জটিলতা বা ঝুঁকি থাকে না বললেই চলে। তবে শীতে এর প্রকোপ অনেকাংশে বেড়ে যায়। শীতের আগেই চিকিৎসককে দেখিয়ে ইনহেলার বা অন্যান্য ওষুধের ডোজ সমন্বয় করে নিন। শোবারঘরটি উষ্ণ রাখার চেষ্টা করুন, ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা করুন। শীতে পর্যাপ্ত গরম জামা-কাপড় পারবেন ও সচেতন থাকুন। 

শীতকালীন রোগ প্রতিরোধের আরো প্রয়োজনীয় সতর্কতা

  • শীতে প্রচুর পরিমাণে পানি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এসময়  পানি খাওয়া কম হয়। ফলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। এছাড়া পানি জাতীয় গরম খাবার বেশী বেশী খেতে হবে।
  • শীতে ভিটামিন সি জাতীয় খাবার বেশী খাওয়া উচিত। ভিটামিন সি ঠান্ডা লাগার প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করে।
  • শীতকালে অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। শীতে ধুলাবালি বেশী থাকায় তাতে রোগ-জীবাণু বেশী থাকে এবং সে কারণে অসুখে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে। তাই এসময়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা বেশী প্রয়োজন।
  • প্রতিদিন খাবারে রসুন ব্যবহার করা ,কালোজিরা রান্না বা ভর্তা খাওয়া ভালো । আদা ও লবঙ্গ দিয়ে চা খেতে পারেন এগুলো  ঠান্ডা লাগা কমাতে অধিক কার্যকর। 

Leave a Comment