টাইফয়েড জ্বরের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

by Dr. Baby Akter
টাইফয়েড-জ্বর-ও-চিকিৎসা

আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে গরমকালের শুরুতে বা শেষে  সময়ে দেখা দেয় নানা অসুখ বিসুখ। যেগুলি মানুষ থেকে মানুষে, মশা থেকে মানুষে, জল থেকে মানুষে ছড়ায়। এগুলি বেশিরভাগই সংক্রামক ব্যাধি। এ সময়ে ছড়ায় এমনি একটি মারাত্মক রোগ হল টাইফয়েড। আজ আমরা টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ, কারণ, চিকিৎসা ও কীভাবে তার প্রতিরোধ করা যায় সে বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করব।

সালমোনেলা টাইফি (Salmonella Typhi) ও প্যারাটাইফি জীবাণু থেকে টাইফয়েড রোগ হয়ে থাকে।  টাইফয়েড রোগ জলবাহিত। জ্বরের সময় তাপমাত্রা ১০৩ থেকে ১০৪ ফারেনহাইট অব্ধি হয়, তবে অনেক ক্ষেত্রেই এই জ্বর প্রথম সপ্তাহে ধরা পড়ে না। ওষুধ চললেও সপ্তাহ খানেক থাকতে পারে এই জ্বর। দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহে জ্বর ধরা পড়ে এবং মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। 

শরীরে জীবাণু প্রবেশ করলেই টাইফয়েড হয়ে যাবে এমন কোন কথা নেই , কারণ দেহে যদি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকে তাহলে অনেক সময়ই জীবাণু দেহে সংক্রমণ করতে পারেনা।

টাইফয়েড জ্বর কী ?

টাইফয়েড একটি অত্যন্ত পরিচিত সংক্রামক অসুখ যা সালমোনেলা এন্টেরিকা (Salmonella Enterica)-র টাইফি, প্যারাটাইফি A, B, এবং C নামক বিভিন্ন প্রজাতির দ্বারা ঘটে। টাইফয়েড এবং প্যারাটাইফয়েড জ্বর একত্রে আন্ত্রিক জ্বর হিসাবে পরিচিত। এই অসুখটা প্রাক-বর্ষা, বর্ষা এবং বর্ষা শেষেই সাধারণত বেশি মাত্রায় ছড়ায়। মল এবং মৌখিক (ওরাল) পথের মাধ্যমে টাইফয়েডের সংক্রমণ ঘটে। যদি সঠিক চিকিৎসা না করা হয়, অবস্থা আরও গুরুতর দিকে চলে যেতে পারে এবং জীবাণুগুলি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। এতে  আভ্যন্তরীণ রক্তপাত, পচন বা সেপসিস অথবা বিরল ক্ষেত্রগুলিতে রোগীর মৃত্যু অব্ধি হতে পারে৷

টাইফয়েড জ্বরের কারণ 

টাইফয়েড কে পানিবাহিত রোগের মধ্যে একটি মারাত্মক রোগ হিসেবে ধরা হয় যা আমাদের দেহে সাধারণত দুই ধরনের জীবাণুর সংক্রমণে হয়ে থাকে।

(১) সালমোনেলা টাইফি এবং

(২) সালমোনেলা প্যারাটাইফি

সালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে যে জ্বর হয় তাকে টাইফয়েড জ্বর বা এন্টারিক ফিভার বলে। আর যদি সালমোনেলা প্যারাটাইফি নামক জীবাণুর কারণে এ জ্বর  হয় তখন তাকে প্যারা টাইফয়েড জ্বর বলে। প্রধানত দূষিত পানি ও খাবার গ্রহণের মাধ্যমেই। শরীরে এই জীবাণু প্রবেশ করে তাছাড়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি উদাসীনতার কারণেও এটি শরীরে প্রবেশ করতে পারে। টাইফয়েড জ্বর হতে আরোগ্য লাভ করেছেন কিন্তু এই ব্যাকটেরিয়া বহন করছেন এমন কিছু সংখ্যক ব্যক্তিও এই রোগের বাহক হতে পারে বলে মনে করা হয়। এই জীবাণু শরীরে যেভাবেই প্রবেশ করুক তা শরীরে প্রবেশের পর বৃহদান্ত্রকে আক্রমণ করে। এছাড়া মানব শরীরের পিত্তথলিতে সাধারণত এই ব্যাকটেরিয়া জমা থাকে এবং উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়ার সাথে সাথে এটি দ্রুত গতিতে শরীরে আক্রমণ করে থাকে।

টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণগুলি কী কী?

অনেকাংশেই আর পাঁচটি জ্বরের মতই টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণগুলি তবে বেশ কিছু উপসর্গ আছে তবে যেগুলিকে একেবারেই আলাদা কোন অবস্থাতে তা অবহেলা করা উচিত নয়।

  • প্রবল জ্বর , তাপমাত্রা ১০২°- ১০৪° ফারেনহাইটের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। 
  • কাশি
  • পেট খারাপ
  • পেট ব্যথা
  • কোষ্ঠকাঠিন্য
  • ক্ষুধামান্দ্য
  • মানসিক অবসাদ
  • বুক এবং তলপেটে লাল ফুসকুড়ি
  • নাক দিয়ে রক্ত পড়া
  • মস্তিষ্কের বিভ্রান্তি বা বিভ্রম
  • মনোযোগে ঘাটতি
  • প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মধ্যে টাইফয়েড সংক্রমণের উপসর্গগুলি অপেক্ষাকৃত কম দেখা যায়।

টাইফয়েড হলে কী করবেন

রক্ত পরীক্ষা

টাইফয়েড পানিবাহিত জীবাণুর মাধ্যমে ছড়ায়। তাই টাইফয়েড হয়েছে কি না, তা বুঝতে সবার আগে অসুস্থ ব্যক্তির রক্ত পরীক্ষা করতে হবে।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা

নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। অবশ্যই হাত ভালোভাবে ধুতে হবে। সব সময় পরিষ্কার পোশাক পরতে হবে।  ঘরের জিনিসপত্র নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিসপত্র আলাদা করে রাখতে হবে।

খাবারে ও পানির সতর্কতা

বাইরের খাবার খেলে সব সময় সচেতন থাকতে হবে। পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে। অপরিষ্কার শাক-সবজি ও কাঁচা-ফলমূল খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। খাবার গরম করে খেতে হবে। 

স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ও বাসস্থান  সুব্যবস্থা

আক্রান্ত ব্যক্তির টয়লেট নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে খোলামেলা ও পরিষ্কার বাসায় রাখতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে কোনোভাবেই যেন টয়লেটে ময়লা বা পানি জমে না থাকে। 

অবশ্যই রোগীকে একজন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে এবং টাইফয়েড হয়েছে কি না তা  রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে, তেমনি ওষুধ খাওয়ার বিষয়টি ও নিশ্চিত করতে হবে। 

টাইফয়েডের চিকিৎসা কিভাবে সম্ভব ?

টাইফয়েডের প্রাথমিক উপসর্গগুলি দেখা দেওয়া মাত্র ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। 

সাধারণত যে যে পদ্ধতিতে টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করা হয় তা হলো 

অ্যান্টিবায়োটিক

টাইফয়েড জ্বরের পরীক্ষায় রিপোর্ট অনুযায়ী, ৭ থেকে ১৪ দিনের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক এর প্রয়োগ করা হয়।

ডাক্তারের নির্দেশনা মোতাবেক নিয়ম অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স শেষ করতে হবে ৷ অনেক সময় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার শুরু করার পর ২-৩ দিনেই উপসর্গ গুলি হ্রাস পেতে শুরু করে, কিন্তু কোনোভাবেই  অ্যান্টিবায়োটিক নেওয়া বন্ধ করা যাবেনা।

টাইফয়েড ভ্যাক্সিন

সাধারণত দুই ধরনের ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টাইফয়েডের বাহক, বাহকের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়৷ একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের টাইফয়েড ভ্যাক্সিনের প্রয়োজন হয় না। তবে ডাক্তার মনে করলে ভ্যাক্সিন নেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন।

হাইড্রেশন

বিশুদ্ধ পানীয় জল, ওআরএস, ফলের রস খেতেই হবে৷ টাইফয়েডে আক্রান্ত হলে শরীর থেকে প্রচুর জল বেরিয়ে যায়। অনেক সময়ই রোগী ডিহাইড্রেটেড হয়ে অজ্ঞান পর্যন্ত হয়ে যায়। তাই এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে।

গুরুতর ক্ষেত্রে

যদি রোগীর অবস্থা গুরুতর হয় অথবা ওষুধে কাজ না হলে , সেক্ষেত্রে  অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার দ্রুত কাজ করতে এবং উপসর্গগুলির তীব্রতা কমাতে সাহায্য করে৷

দ্বিতীয় বারের পরীক্ষা

রোগীর মলে বা রক্তে আর টাইফয়েডের জীবাণুগুলি বর্তমান নেই তা নিশ্চিত করার জন্য সম্পূর্ণ চিকিৎসার পর দ্বিতীয়বার একটি মল বা রক্ত পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। যদি পরীক্ষা রিপোর্ট পজিটিভ আসে সেক্ষেত্রে টাইফয়েড জীবাণুর একজন বাহক (কেরিয়ার) হিসাবে গণ্য করা হবে। এরকম ক্ষেত্রে ডাক্তার সাধারণত একটি ২৮ দিনের মৌখিক অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পূর্ণ করে পুনরায় পরীক্ষা করাতে বলেন।

You may also like

Leave a Comment