স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া কোন মানসিক রোগ নয় । এটি অ্যালঝেইমার ডিজিজ যা ডিমেনশিয়ার একটি সাধারণ রূপ , ব্রেনের ক্ষয়জনিত রোগ । এটি রোগীকে দৈনন্দিন কাজ করতে , বন্ধু-বান্ধব , আত্নীয়-স্বজনকে চিনতে এবং কোনো কথা বুঝতে বাধা দেয়। সাধারণত , প্রবীণদের ক্ষেত্রে এই রোগ বেশি দেখা যায় হঠাৎ করে কোন কথা মনে রাখতে পারছেন না । ফলে তার দৈনন্দিন জীবন অচল এবং অস্বাভাবিক হয়ে পড়।
মানসিক রোগ হলো সেটাকে বলা যেখানে মস্তিষ্কের কাঠামো (ব্রেন স্ট্রাকচার) স্বাভাবিক কিন্তু আচরণ অস্বাভাবিক থাকে। অ্যালঝেইমার ডিজিজ যা ব্রেনের ক্ষয়জনিত কারণে ব্যক্তির বুদ্ধি , স্মৃতি ও ব্যক্তিত্ব ধিরে ধীরে লোপ পায় ।
স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া বা আলঝেইমারস রোগের ইতিহাস
১৯৬০ সালে ডা. এলইস আলঝেইমারস রোগ সর্বপ্রথম এই রোগের গবেষণা করেন । আগস্তির দেতার নামের ব্যক্তির স্মৃতিগত দুর্বলতা ,কথা বলতে কষ্ট হওয়া , সঠিক শব্দটি স্মরণ করতে না পারা , খিটখিটে মেজাজ , রাগ ,অসহিষ্ণুতা, সন্দেহপ্রবণতা ইত্যাদি সমস্যায় ভুগছিলেন। দেতার এর মৃত্যুর পর তিনি দেখলেন যে , তার মস্তিষ্ক ছিল চুপসে যাওয়া ছোট আকারের স্নায়ুতন্ত্র গুলো স্নায়ুতন্তুগুলো এমাইলয়েড প্ল্যাক দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত আর অবশিষ্ট নিউরনগুলো নিউরোফিব্রিলারি ট্যাঙ্গেলে ভরপুর।
পরবর্তীকালে ডা. এলইস আলঝেইমার নাম অনুসারে এই রোগের নামকরণ করা হয় আলঝেইমারস রোগ।
উন্নয়নশীল বিশ্বে ক্রমান্বয়ে গড় আয়ু বাড়ার পাশাপাশি এই রোগের প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। ৬০ বছর বয়সের পর থেকে আলঝেইমার হওয়ার আশঙ্কা দ্বিগুণ হতে থাকে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং নারীদের মধ্যে এর প্রকোপ বেশি।
স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ার কারণ
চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, বংশ ও জিনগত,পরিবেশগত কারণ এবং জীবনযাপনের ধরন ইত্যাদি। আমাদের মস্তিষ্কে নন-এনজাইমেটিক গ্লাইকেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অ্যাডভান্সড গ্লাইকেশন অ্যান্ড প্রডাক্ট জমা হওয়া। এগুলো নিউরন এবং সেগুলোর আন্তসংযোগ নষ্ট করে দেয়। ফলে বিশেষ ধরনের প্রোটিন মস্তিষ্কের কোষে জমা হয়ে ক্ষতি সাধন করে। গ্লুকোজ এর পরিমাণ স্বাভাবিক থাকলে ধীরগতিতে এবং বেশি থাকলে দ্রুতগতিতে এসব পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এতে ধীরে ধীরে ব্যক্তি আলঝেইমারস রোগে আক্রান্ত হয় ।
এ ছাড়াও আরো কিছু কারণ রয়েছে যেমন
- স্ট্রেস অথবা অ্যাংজাইটির কারণে শরীরের মতো মস্তিষ্কও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এতে ধীরে ধীরে কমে যেতে পারে স্মৃতিশক্তি।
- রাতে না ঘুমানোর অভ্যাস থাকলে সেটি মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। এতে ধীরে ধীরে কমতে থাকে স্মৃতিশক্তি।
- ভিটামিন বি ১ এবং বি ১২ এর অভাবে এমনটি হতে পারে।
- মেনোপজের সময় হরমোনের পরিবর্তন হয়। এ সময়েও অনেকে ভুলে যাওয়ার রোগে ভুগতে পারেন।
- দীর্ঘমেয়াদি ডিপ্রেসন বা হতাশার কারণে লোপ পেতে পারে স্মৃতি।
- অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে কমতে পারে স্মৃতি ধারণ ক্ষমতা।
- মস্তিষ্কে আঘাত লাগলে স্মৃতিশক্তি কমে যেতে বা স্মৃতি নষ্ট হয়ে যেতে পারে ।
চিকিৎসা এবং প্রতিকার
নানা রকম জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি একই সঙ্গে আলঝেইমারস রোগেও ভুগতে পারেন। কিছু ওষুধ রোগীর স্মৃতিশক্তি অল্প কিছুদিন ধরে রাখতে সাহায্য করে বটে, তবে সময়ের সঙ্গে কার্যকারিতা হ্রাস পায়।
সেক্ষত্রে আমরা জীবনাচরণের ধরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে স্মৃতিশক্তি ধরে রাখতে পারি। যেমনঃ
- ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করলে দেহের পেশির সাথে সাথে মস্তিষ্কের আকারও বৃদ্ধি পায়। ব্যায়াম করলে মস্তিষ্কের সিন্যাপসের সংখ্যা বাড়ে। এর ফলে মস্তিষ্কে নতুন নতুন কোষ তৈরি হয়। আর কার্ডিওভাসকুলার ব্যায়ামের ফলে মস্তিষ্কে বেশি হারে অক্সিজেন এবং গ্লুকোজ সরবরাহ হয়। ফলে স্মৃতিশক্তি প্রখর থাকে।
- স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর জন্য সঠিক খাবার গ্রহণ করুন। মস্তিষ্কের কোষ ফ্যাট অর্থাৎ স্নেহ পদার্থ দিয়ে তৈরি। তাই খাবার থেকে তেল-চর্বি একেবারে বিদায় না করাই ভাল। বাদাম, তেলের বীজ, মাছ ইত্যাদি মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যে জন্য ভাল। আর খাবার সময় একা একা না খাওয়াই ভাল। সবার সাথে বসে খাবার খেলে তা মস্তিষ্কের জন্য সুফল বয়ে আনে।
- মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ মস্তিস্কের জন্য খুবই খারাপ তাই মস্তিষ্ককে অবসর দিয়ে, এবং নিজেকে মূলত: সুইচ অফ করে, আপনি আপনার মস্তিস্কের ভিন্ন একটি অংশকে ব্যায়াম করার সুযোগ করে দেয়া প্রয়োজন। এতে দেহের স্ট্রেস হরমোন কমাতে সাহায্য করবে।
- সুরের মাধ্যমে জেগে ওঠে মস্তিষ্ক। বাড়ে মেধা। সঙ্গীত ডিমেনশিয়ার মত মানসিক অবস্থা ঠেকাতে বেশ কার্যকরী। তাই স্মৃতিশক্তি প্রখর রাখতে সুর এবং সঙ্গীতের মাঝে নিজেকে আবদ্ধ রাখুন।
- দৈনিক পাঁচ ঘণ্টার কম ঘুম হলে মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আর ১০ ঘণ্টার বেশি ঘুম হলে মস্তিষ্ক সজাগ হওয়ার সময় পায় না। দিনের শুরুর সাথে তাল মিলিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠুন। এটি মস্তিষ্কের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী এবং স্মৃতিশক্তিও ভালো রাখে।
স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ার রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা
এছাড়াও আমরা দৈনন্দিন জীবনে নিমোক্ত উপায়ে ঘরোয়া চিকিৎসার মাধ্যমে আলঝেইমার রোগ বা স্মৃতিশক্তি হ্রাসের চিকিৎসা করতে পারি। যেমনঃ
- ৭ দানা কাঁচা বাদাম সন্ধ্যাবেলায় কাচের বাসনে ভিজিয়ে রেখে পরদিন সকালে বাদামের লাল খোসা ছাড়িয়ে মিহি করে বেটে নিন. এই বাদাম বাটা ২৫০ গ্রাম দুধে দিয়ে দিন দুধটা দুই/তিন বার ফেঁপে উঠলে নামিয়ে ১ চামচ ঘি ২ চামচ বা চিনি বা মিছিরি গুড দিয়ে ঠান্ডা করে নিন.খাওয়ার মতো গরম থাকা অবস্থায় সেবন করুন।এভাবে ১৫ থেকে ৪০ দিন নিয়মিত পান করুন। এটি স্মৃতিশক্তি বাড়াতে অত্যন্ত কার্যকরী প্রাকৃতিক চিকিৎসা।
- সকালে এই দুধ খাওয়ার পর দু’ঘন্টা অন্য কিছু খাওয়া বা পান বিরত থাকতে হবে ।
- বাদামকে মিহি করে পিষে নিলে তা হজম করতেও সুবিধা হয় এবং অল্প বাদামেও কাজ হয়.
স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া বা আলঝেইমারস রোগীর জন্য পরামর্শ
অ্যালঝেইমার ডিজিজে আক্রান্ত রোগীর মস্তিষ্ক স্মৃতিশক্তি হারালেও অনুধাবনের শক্তি, ইগো, সম্মানবোধ এবং ব্যক্তিত্ব হারান না। তিনি কোনো অবহেলা, অযত্ন বা দুর্ব্যবহার আশা করেন না। নিজের অক্ষমতার জন্য তিনি উৎকণ্ঠিত, উদ্বিগ্ন থাকেন এবং অসহায় বোধ করেন। তাদের সঙ্গে বিনা কারণে দুর্ব্যবহার না করে প্রিয়জন ও আপন জনদের বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে। ওষুধের পাশাপাশি সেবা ও পরিচর্যা, ভালোবাসা, পারিবারিক, সামাজিক ও সাংগঠনিক ভাবে তাদেরকে সাহায্যের হাত বাডিয়ে দিতে হবে।