মাথা ব্যথার কারন ও মুক্তির উপায়

by Dr. Baby Akter
মাথা ব্যথা কেন হয় ও মুক্তির উপায়

মাথা ব্যথা এক গুরুতর সমস্যা। স্নায়ুরোগের মধ্যেও মাথাব্যথার হার সবচেয়ে বেশি। বর্তমান সময়ে প্রচুর মানুষ এই রোগে আক্রান্ত।  এ রোগের কারণে যে কোনো ব্যক্তির কার্যক্ষমতা ও কার্যকাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। ফলে ভুক্তভোগীরা পেশাগত, সামাজিক, পারিবারিক ও আর্থিক জীবনে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বিশ্বের মোট ১৮-৬০ বছর বয়সী জনসংখ্যার প্রায় ৪৬ ভাগ প্রতিবছর মাথাব্যথায় একবার না একবার আক্রান্ত হয় এবং প্রতিবছর ২০%  শিশু ও কিশোর মাথাব্যথা রোগে ভুগে থাকে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন ধরনের মাথাব্যথায় বেশি কষ্ট পান বয়স্ক নারীরাই। 

মাথাব্যথার অন্যতম কারণ হলো-অতিরিক্ত মানসিক চাপ, রোদ বা প্রচন্ড গরম আবহাওয়া, অধিক পরিশ্রম, ক্ষুধার্ত থাকা, অনিয়মিত ও অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবন, অতি মাত্রায় চা ও কফি পান, মাদক সেবন, অতিরিক্ত ধূমপান ইত্যাদি। তাই এ ধরণের অভ্যাসের বা আচরণের পরিবর্তন করা ও পর্যাপ্ত ঘুম, মেডিটেশন, সুনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম, ইতিবাচক জীবনচর্চা ইত্যাদির মাধ্যমে মাথাব্যথা অনেকাংশে নিরাময় করা সম্ভব।

মাথা ব্যথা কেন হয়?

মাথা ব্যথা বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। তবে ধরণ দেখে খুব বুঝে নেওয়া সম্ভব ঠিক কি কারণে মাথা ব্যথা করছে। মাথা ব্যথার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম দুটি কারণ হচ্ছে-মাইগ্রেন আর টেনশন। তা মধ্যে ৭০% রোগীর মাথা ব্যথার কারণ হলো টেনশন টাইপ হেডেক। এবং ১১% জন্য দায়ী মাইগ্রেন। অনিয়মিত ও অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবন, মাদকাসক্তি, ধূমপান, মদ্যপান, রোদ বা অতিরিক্ত গরম আবহাওয়া, ক্ষুধার্ত থাকা, অতিরিক্ত শারীরিক-মানসিক পরিশ্রম, মানসিক চাপ ইত্যাদি কারণে মাথা ব্যথা হয়ে থাকে। সুতরাং মাথা ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে হলে সর্বপ্রথম এ ধরণের জীবনাচরণ বা অভ্যাসগুলো পরিহার করতে হবে। 

মাথাব্যথার প্রকারভেদ

মাথাব্যথা প্রধানত দুই প্রকার।

১. প্রাইমারি হেডেক (Primary Headache), যেমন- টেনশন টাইপ হেডেক, মাইগ্রেন, ক্লাস্টার হেডেক ইত্যাদি।

২. সেকেন্ডারি হেডেক (Secondary Headache), যেমন- মাথার আঘাতজনিত, গ্লুকোমার স্ট্রোক, মস্তিষ্কের টিউমার সাইনোসাইটিস, মাসটয়ডাইটিস ইত্যাদি।

টেনশন টাইপ হেডেক (Tension-Type Headaches)

প্রায় ৭০ ভাগ বয়স্ক মানুষ টেনশন টাইপ হেডেক ধরনের মাথাব্যথায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। এটি মাইগ্রেনের মতো হয়ে থাকে, এবং কৈশোর কাল থেকে শুরু হয়। নারীদের মধ্যে টেনশন টাইপ হেডেক বেশি দেখা যায়। সাধারণত মাথার মাংসপেশির সংকোচনের ফলে এই মাথাব্যথা হয়ে থাকে ।

টেনশন টাইপ হেডেকের লক্ষণ

  • মাথায় একটা চাপ চাপ ব্যথা অনুভূত হয়।
  • সাধারণত মাথাব্যথার সঙ্গে বমি ভাব বা বমি হয় না।
  • পুরো মাথায় ব্যথা হয়।
  • রোগী ব্যথা নিয়ে সব ধরনের কাজকর্ম করতে পারেন, কাজকর্ম চলাকালীন এ ব্যথা কম অনুভূত হয়। কাজ শেষে বিশ্রামে থাকলে ব্যথা বেড়ে যায়। তবে এই ব্যথা মাইগ্রেনের মতো ততটা তীব্র হয় না।
  • এই মাথাব্যথা সময়কাল কয়েক ঘণ্টাও হতে পারে আবার কয়েকদিন পর্যন্তও স্থায়ী হতে পারে। 
  • পারিবারিক বা পেশাগত বা মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তার ইত্যাদির সঙ্গে এই মাথাব্যথার সম্পর্ক আছে।

মাইগ্রেন (Migraine)

প্রায় ১১ শতাংশ বয়স্ক ব্যক্তিদের এই ধরণের মাথাব্যথা হয়ে থাকে। পুরুষদের থেকেও নারীদের মাইগ্রেনের আক্রান্তের হার বেশি। সাধারণত কিশোর বয়স থেকে এই মাইগ্রেনের ব্যথা দেখা দিতে শুরু করে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ৪০-৫০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। 

মাইগ্রেনের লক্ষণ

  • মাইগ্রেনের অন্যতম লক্ষণ হল- মাথার যে কোনো এক পাশে ব্যথা হওয়া। অনেক সময় একবার এক পাশে ব্যথা উপশম হয়ে আবার অন্য পাশেও ব্যথা শুরু হতে পারে।
  • ব্যথা অত্যন্ত তীব্র হয় এবং এ সময় কোনো কাজ করা যায় না।
  • ৪ ঘণ্টা থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যথা স্থায়ী হতে পারে।
  • আলো বা শব্দে ব্যথার তীব্রতা বেড়ে যায়।
  • রক্তনালি (ধমনি/শিরা) সংকোচন/প্রসারণ বা টনটন প্রকৃতির ব্যথা অনুভূত হয়।
  • ব্যথার সঙ্গে বমি ভাব বা বমি হতে পারে।
  • অন্ধকার ঘরে শুয়ে থাকলে ব্যথার তীব্রতা কমে।
  • রোগীর ব্যথা শুরুর আগে চোখের সামনে আঁকাবাঁকা লাইন, আলোর নাচানাচি ইত্যাদি দেখা। 

ক্লাস্টার হেডেক (Cluster Headaches)

অপেক্ষাকৃতভাবে ক্লাস্টার হেডেক কম দেখা যায়, মাত্র 0.১ ভাগ মানুষের এই ধরনের মাথাব্যথা হয়ে থাকে। এই ধরণের মাথা ব্যথা পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এটি পুরুষ : মহিলার আনুমানিক হার= ৬:১। সাধারণত ক্লাস্টার হেডেক ২০ বছর বয়সের পরে দেখা যায়।

ক্লাস্টার হেডেক লক্ষণ

  • ব্যথা অত্যন্ত তীব্র হয়।
  • ক্ষণস্থায়ী, তবে বারবার হয়।
  • চোখের চারপাশে বা পেছনে ব্যথা হয়।
  • দিনে কয়েকবার বা নিয়মিত একই সময়ে ব্যথা হয়ে থাকে। কয়েক সপ্তাহব্যাপী পর্যন্ত ব্যথা থাকতে পারে। একটি নির্দিষ্ট সময় পর ব্যথা চলে যায় আবার কয়েক মাস বা বছর আবার একইভাবে ব্যথা শুরু হয়। 

সেকেন্ডারি হেডেক (Secondary Headache)

শারীরিক অসুস্থতা বা মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগের কারণে এ ধরণের মাথাব্যথা হতে পারে। এ ধরণের মাথাব্যথাকে সেকেন্ডারি হেডেক বলা হয়ে থাকে। যেমন- সাইনোসাইটিস, মস্তিষ্কের টিউমার, রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোক (এসএএইচ), মস্তিষ্কের আবরণে প্রদাহ (ভাইরাল, ব্যাকটেরিয়ার বা টিউমারফুলার মেনিনজাইটিস), টাইফয়েড, ভাইরাল, মাথায় আঘাতজনিত কারণ ইত্যাদি।

রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা

সাধারণত অধিকাংশ মাথাব্যথার রোগীই ডাক্তারের কাছে যেতে চান না বা চিকিৎসা নেন না। নিজেই ফার্মেসিতে গিয়ে বেদনানাশক বিভিন্ন ঔষধ কিনে সেবন করেন। এক পরিসংখ্যান মতে,  যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এর মত দেশগুলোতেও মাইগ্রেনের রোগী চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছেন মাত্র ৫০ শতাংশ। 

দেখা গেছে, মাথা ব্যথার সেকেন্ডারি হেডেকের রোগীদের বিভিন্ন ধরণের শারীরিক সমস্যা যেমন -খিঁচুনি, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, অতিরিক্ত বমি, পা বা মুখ অবশ বা নিসাড় হওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়ার পর চিকিৎসকের পরামর্শে যান। 

বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভুতপূর্ব সাফল্যের ফলে খুব সহজেই মাথাব্যথার কারণ নির্ণয় করা যায়। এমআরআই, সিটি স্ক্যান, পিইটি স্ক্যানের মাধ্যমে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের সুস্পষ্ট ইমেজ পাওয়া যায়। এতে মাথাব্যথার কারণ খুব সহজে উদঘাটন করা সম্ভব। মাথাব্যথার  কারণ বা ধরন অনুযায়ী চিকিৎসা জন্য আগে রোগ নির্ণয় করা আবশ্যক। 

প্রচলিত বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতিতে মাথা ব্যথা নিরাময়ের চিকিৎসা করা যায়। তবে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এর তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। 

মাথা ব্যথার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা 

হোমিওপ্যাথিতে রোগের লক্ষণের সাদৃশ্য ঔষধ প্রয়োগর মাধ্যমে মাথা ব্যথার চিকিৎসা করা হয়। তাই লক্ষণভেদে ঔষধও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। মাথা ব্যথার লক্ষণ অনুসারে যে ঔষধগুলো প্রয়োগ করা যায় সেগুলো হলো-

বেলেডোনা (Belladonna)

মাথা ব্যথা থেকে মুক্তির জন্য এই ঔষধ ভালো কাজ করে। প্রাথমিকভাবে মাথা ব্যথা নিরাময়ের জন্য এটি খুবই কার্যকরী। সূর্যের প্রচণ্ড রোদে যাদের মাথা যন্ত্রণা বেড়ে যায় এবং ঠান্ডা লাগলে বা ভ্যাপসা ঠাণ্ডা গরমে এরকম মাথাব্যথা বেড়ে যায়। এ ধরণের লক্ষণের ক্ষেত্রে বেলেডোনা প্রয়োগ করা যায়। 

নাক্সভোমিকা (Nux-vomica)

গ্যাসট্রিকের সমস্যা, পাইলস ও কোষ্ঠকাঠিন্যে মাথাযন্ত্রণা করলে এই ঔষধ ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া অতিরিক্ত তেলমশলা জাতীয় খাবার গ্রহণ এবং অ্যালকোহলের সেবনের কারণে মাথা ব্যথা হলে নাক্সভোমিকা প্রয়োগে ভালো ফল পাওয়া যায়। 

স্পাইগেলিয়া (Spigelia)

মাথার বামদিকের বিশেষ করে মাইগ্রেনের ব্যথার ক্ষেত্রে স্পাইগেলিয়া প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে সাধারণত রোগীর বাঁ দিকের কিছু কিছু অংশ, কপাল এবং চোখে ব্যথা করে। 

স্যাঙ্গুইন্যারিয়া ক্যানাডেনসিস (Sanguinaria canadensis)

রোগীর মাথা ব্যথা ডানদিক থেকে ব্যথা শুরু হয়ে  ধীরে ধীরে মাথার পিছনে ছড়িয়ে পরে এবং ডানদিকের চোখে এটা স্থিত হয়। সকালবেলা বা দিনের বেলার মাথা ব্যথা নিরাময়েও এই  ঔষধ কাজ করে। মহিলাদের মেনোপজের পর যে মাথা ব্যথা হয়ে থাকে তাতেও স্যাঙ্গুইন্যারিয়া ক্যানাডেনসিস কার্যকরী। 

গ্লোনোনিয়াম (Glononium)

মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক রক্ত জমা হলে যে মাথা ব্যথার সৃষ্টি হয় তাতে গ্লোনোনিয়াম উত্তম কাজ করে। মাথা যন্ত্রনায় রোগী মনে করে মাথা ফেটে যাবে বা মাথাপুড়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো রোগী মনে করে মাথা আকারে বেড়ে যাচ্ছে বা চোখের চারপাশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অত্যাধিক তাপের ফলে মাথা ব্যথা করলেও গ্লোনোনিয়াম খুব কার্যকরী ঔষধ। 

তবে কখোনই নিজ দায়িত্বে ফার্মাসী থেকে ঔষধ কিনে খাওয়া নিরাপদ নয়। মাথা ব্যথার সমস্যার জন্য যদি হোমিও চিকিৎসা নিতে চান , সেক্ষেত্রে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ হোমিওপ্যাথি  চিকিৎসকের নিকট শরণাপন্ন হবেন।। তিনি আপনার মাথাব্যথার কারণ নির্বাচন করে সঠিক ওষুধ দেবেন।

ওষুধের পাশাপাশি কিছু কিছু অভ্যাসও পরিবর্তন করতে হবে। অনিয়মিত ও অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবন, অতি মাত্রায় চা ও কফি পান, মদ্যপান, মাদক সেবন, অতিরিক্ত ধূমপান, অতিরিক্ত শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম, ক্ষুধার্ত থাকা, রোদ বা অতিরিক্ত গরম আবহাওয়া, যেকোনো ধরনের মানসিক চাপ ইত্যাদি মাথাব্যথার অন্যতম কারণ। তাই এধরণের অভ্যাসের বা আচরণের পরিবর্তন ফলে মাথাব্যথা অনেকাংশে কমে আসবে।

একই সাথে  পর্যাপ্ত ঘুম,  মেডিটেশন , সুনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস,  শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম,  ইতিবাচক জীবনচর্চা  ইত্যাদি মাথাব্যথার প্রকোপ কমাতে সাহায্য করে।

You may also like

Leave a Comment