সম্প্রতি আফ্রিকাসহ আশপাশের দেশগুলোতে এমপক্স ভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। সময়ের সাথে সাথে এশিয়া ও ইউরোপের দেশেগুলোতেও ছড়াচ্ছে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে এই ভাইরাস প্রায় ১০০ টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ার কারণে সে সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এমপক্স ভাইরাস নিয়ে জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিল। অবশ্য পরবর্তীতে টিকা প্রদানের মাধ্যমে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়।
২০২৩ সালের জুলাই মাসে সংক্রমণ আরো বেড়ে যায়। ২০২৪ সালের শুরু থেকে জুলাই পর্যন্ত এ রোগের সংক্রমণ হয় ১৪৫০০ এর বেশি মানুষ, এর মধ্যে প্রায় ৪৫০ জন জন লোক মারা যায়। ফলে এমপক্স নিয়ে সম্প্রতি সারা বিশ্বে গণস্বাস্থ্যে জরুরি অবস্থা জারি করেছে স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)।
মাঙ্কিপক্স বা এমপক্স কী?
এমপক্স হল এক ধরণের ভাইরাসজনিত রোগ। এটি গুটিবসন্ত বা স্মলপক্স এর জন্য দায়ী ভাইরাসের শ্রেণীভুক্ত। তবে গুটিবসন্ত ভাইরাসের চেয়ে এমপক্স ভাইরাস তুলনামূলক কম ক্ষতিক্ষর। এমপক্স এর প্রধানতঃ দুটি ধরণ রয়েছে : ক্লেড-১ ও ক্লেড-২। ধরণ দুটির মধ্যে আবার সাব ডিভিশন রয়েছে এ এবং বি। মাঙ্কিপক্স ভাইরাস শুরুতে পশুপ্রাণী থেকে মানুষের শরীরে ছড়ায়। তবে এই রোগটি এখন মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ঘটছে।
এমপক্স ভাইরাস বেশি দেখা যায় আফ্রিকার গ্রামীণ এলাকায় যেখানে সাধারণত বৃষ্টিপাত বেশি হয়। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো (ডিআর কঙ্গো) এ ভাইরাসের বেশি প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায়। এই দেশটিতে এমপক্স ভাইরাসের কারণ ছিল মূলত ক্লেড-১ ভাইরাস। ক্লেড-২ ভাইরাস ছড়িয়েছে ইউরোপে। ক্লেড-১ ভাইরাসের তুলনায় ক্লেড-২ ভাইরাসের মৃত্যু হার তুলনামূলক কম। ক্লেড-১ ভাইরাসে আক্ৰান্ত রোগীর প্রতি ১০০ জনে ৪ জনের মৃত্যু হয়। তাই ক্লেড-১ ভাইরাসটি ক্লেড-২ থেকে অধিক গুরুতর।
এমপক্স কীভাবে ছড়ায়?
এমপক্স ভাইরাস একটি পানিবাহিত রোগ, এটির উদ্ভব ঘটেছে মূলত বন্যপ্রাণী থেকে। আগেকার সময়ে যারা পশু শিকারে যেতেন তাদের মধ্যে এ রোগের সংক্রমণ ঘটতো। কিন্তু এখন মানুষ থেকে মানুষে এ রোগ ছড়াচ্ছে। সে কারণে সংক্রমণের হারও বাড়ছে।
এমপক্স ভাইরাস মূলত যেভাবে ছড়ায় –
- মানুষের সাথে মানুষের শারীরিক সংস্পর্শের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। এমপক্সে সংক্রমিত ব্যক্তির খুব কাছাকাছি অবস্থান করলে, স্পর্শ করলে, শারীরিক ও যৌন সম্পর্ক ইত্যাদির মাধ্যমে এমপক্স ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।
- এমপক্স আক্রান্ত বন্যপ্রাণীর কাছাকাছি বসবাস করলে অথবা শিকারে গেলে, মাংস কাটা, কম তাপে রান্না করা মাংস বা কম তাপে রান্না করা খাবার খাওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে এ ভাইরাস ছড়াতে পারে। যেহেতু আমাদের দেশে বন্যপ্রাণী খুব বেশি শিকার করা হয় না তাই সংক্রমণের হার কম। তবে সংক্রমিত প্রাণী বা ব্যক্তির কাছে গেলে এমপক্স ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে। সেকারণে সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি।
- এ ভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তির ব্যবহার্য জিনিসপত্র যেমন- তোয়ালে, পোশাক, বিছানার চাদর ইত্যাদি ব্যবহারে এমপক্স ভাইরাস ছড়াতে পারে।
- এমপক্স ভাইরাসে সংক্রমিত দেহে ব্যবহার করা ইনজেকশনের সুঁই আরেকজনের শরীরে ব্যবহার করলে এর সংক্রমণ হতে পারে।
- গর্ভবতী নারী এমপক্স ভাইরাসে সংক্রমিত হলে নবাগত সন্তানেরও এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে।
- এমপক্স আক্রান্ত হয়ে ফোস্কা শুকিয়ে যাওয়া অংশ যদি ছড়িয়ে পড়ে তাতেও এটির সংক্রমণ হতে পারে।
এমপক্সের লক্ষণ
এমপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে প্রচন্ড ব্যথা হয়। এই ব্যথা জলবসন্তের থেকেও বেশি অনূভত হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির গলা, পায়ের সন্ধিস্থল, বগলের নিচে থাকা লসিকাগ্রন্থি ফুলে যায়, খুব বেশি ব্যথা হয় যার কারণে শরীরে জ্বর চলে আসে। দেহের ত্বকে পানি ভর্তি ফোস্কা বা ফুসকুড়ি হয় এতে ব্যথা ও চুলকানি থাকে।
এমপক্স প্রাথমিক অবস্থায় থাকলে এমনিতেই চলে যায়। তবে কেউ যদি এমপক্সের কারণে খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন সেক্ষেত্রে মারাত্বক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, অনেক সময় রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।
এমপক্সের চিকিৎসা
এমপক্সের সরাসরি কোন চিৎকিসা বা ঔষধ নেই। এই রোগের মেডিসিন আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে। তবে উপসর্গের ভিত্তিতে কিছু মেডিসিনের মাধ্যমে এর চিকিৎসা দেয়া হয়। লক্ষণভিত্তিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি এক্ষেত্রে খুব ভালো কাজ করে। রোগীকে অবশ্যই আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা নিতে হবে। এবং রোগীকে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ ও পরিস্কার পরিছন্ন পরিবেশে থাকতে হবে।
আফ্রিকায় এমপক্সের চিকিৎসার জন্য গুটিবসন্তের ভ্যাকসিন খানিকটা পরিবর্তন করে এমপক্সের সংক্রমিত ব্যক্তিদের দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে এভাবে ভ্যাকিসন প্রয়োগ করা হবে কিনা তা যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় আনবেন।