মানুষের মলদ্বারের ভেতরে কতগুলো গ্রন্থি রয়েছে কোনো কারণে সেগুলোর সংক্রমণ হলে সেই জায়গায় ফোঁড়া তৈরি হয়। এই ফোঁড়া এক সময় ফেটে গিয়ে পায়ুপথের চারিদিকের, যে কোনো স্থানের একটি নালী বা ছিদ্র তৈরি করে বের হয়ে আসে এবং পুঁজ নিঃসরণ করে। ফলে রোগীর পায়ুপথে প্রচুর ব্যথা অনূভব করে, সারাক্ষন রোগী এক যন্ত্রণাদায়ক সময় পার করে। পূঁজ বের হওয়ার পর রোগীর যন্ত্রনা কিছুটা কমতে থাকে। মলদ্বারের বা পায়ুপথের চারপাশের এ ধরণের এক বা একাধিক নালী ফোঁড়া থেকে পূঁজ আসাকে ফিস্টুলা বা ভগন্দর বলা হয়।
এ রোগটি মূলত মলদ্বারে বিশেষ সংক্রমণের ফলে উৎপত্তি হয়। তাছাড়া মলদ্বারে ক্যান্সার এবং বৃহদান্ত্রের প্রদাহজনিত রোগসহ আরও অনেক কারণেও ফিস্টুলা বা ভগন্দর হতে পারে। সাধারনত চিকিৎসা ছাড়া এরোগ ভালো হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফিস্টুলা বা ভগন্দর সারাতে সার্জারীর প্রয়োজন পড়ে।
এনাল ফিস্টুলা কি কারণে হয় ?
সাধারণত মলদ্বারের সংক্রমের ফলে সৃষ্ট ফোঁড়া থেকে ফিস্টুলা বা ভগন্দর হয়ে থাকে। এছাড়াও আরও কিছু কারণে ফিস্টুলা দেখা দিতে পারে যেমন-
এইচআইভি (এইডস)/টিবি (যক্ষ্মা): এ ধরণের রোগে আক্রান্ত হলে রোগীর ফিস্টুলা দেখা দেয়ার ঝুঁকি থাকে।
ক্রোনস ডিজিজ: এটি একধরনের অন্ত্রের রোগ (IBD) যা পরিপাক নালীতে জ্বালাপোড়া করে এবং পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া সহ আরও বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয়।
মলদ্বারের অপারেশন: মলদ্বারের চারপাশের কোথাও সার্জারী করা হলে সেখান থেকে নতুন নালী সৃষ্টি হয়ে এনাল ফিস্টুলা দেখা দিতে পারে।
হাইড্রাডেনাইটিস সাপুরাটিভা: এটি এক ধরণের রোগ যা শরীরের বেশী ঘাম হওয়া অংশগুলোর চামড়ার মধ্যে কিছু ফোঁড়ার সৃষ্টি হয় ও চামড়া পূরু হয়ে দাগের মত দেখায়।
ডাইভারটিকুলাইটিস: এটি এমন একটি রোগ যা পরিপাক নালীর শেষের অর্থাৎ বৃহদান্ত্রের কিছু স্থানে থলির মত হয়ে ফুলে সংক্রামিত হয়ে পড়ে।
এছাড়া রেডিওথেরাপি, ট্রমা, যৌনরোগ, ক্যানসার এর মত রোগের কারণেও এনাল ফিস্টুলা দেখা দিতে পারে।
আরো পড়ুন: মহিলাদের পাইলস বা অর্শ্বরোগের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা
ফিস্টুলা বা ভগন্দরের লক্ষণ –
এনাল ফিস্টুলার ক্ষেত্রে বেশ কিছু লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন-
- সাধারণত সারাক্ষণ একটি টনটনে ব্যথা থাকে যা হাঁটাচলা করলে, বসলে, কাশি দিলে অথবা পায়খানা করার সময় ব্যথা বেড়ে গিয়ে পায়ুপথের চারপাশ থেকে দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ নির্গত হয়।
- পায়ুপথের চতুর্দিকের ফুলে লাল হয়ে যেতে পারে এবং ফোঁড়া হলে অনেক সময় জ্বরও আসতে পারে।
- মলের সাথে রক্ত ও পূজ বের হয়ে থাকে।
- রোগী মলত্যাগের ক্ষেত্রে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে অর্থাৎপায়খানার চাপ আসলে তা বুঝে উঠার আগে পায়খানা হয়ে যায় বা মলত্যাগের চাপ বেশিক্ষণ নিতে পারে না।
- কিছু কিছু ক্ষেত্রে মলদ্বারের পাশের নালীর মত ছিদ্রটি বাইরের থেকে দেখা যায়। তবে রোগীর ক্ষেত্রে দেখা সাধারণত সম্ভব হয় না।
এনাল ফিস্টুলা হলে করণীয় কি?
ফিস্টুলার লক্ষণগুলো দেখা দিলেই দেরী না করে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ হবে। ডাক্তারকে উপসর্গগুলো ভালোভাবে বুঝিয়ে বলা উচিত। চিকিৎসক সেক্ষেত্রে পায়ুপথের সমস্যার সাথে অন্ত্র বা পরিপাকনালীর অনন্যা সমস্যা আছে কিনা নিশ্চিত করে থাকেন।
মলদ্বারের ফিস্টুলার অবস্থা জানার জন্য চিকিৎসক পায়ুপথে আলতোভাবে আঙ্গুল ঢুকিয়ে যাচাই করতে পারে। এটিকে ডিজিটাল রেকটাল এক্সামিনেশন (DRI) বলা হয়।
এই পরীক্ষার ফলে চিকিৎসক যদি এনাল ফিসারের আশঙ্কা করেন তাহলে এনাল ফিসারের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বা কোলোরেক্টাল সার্জন এর নিকট যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আরও কিছু টেস্ট করে থাকেন এরপর নিশ্চিত হলে ফিস্টুলার সঠিক চিকিৎসা অথবা অস্ত্রোপচারের ব্যাবস্থা গ্রহণ করেন।
এক্ষেত্রে যে টেস্ট বা পরীক্ষা নিরীক্ষা গুলো করা হয়ে থাকে তা হল –
- মলদ্বারে আঙ্গুল ঢুকিয়ে DRI করা হয় ।
- প্রোক্টোস্কোপি করে থাকে যা পায়ুপথে নলের মত একটি বিশেষ যন্ত্র প্রবেশ করানো হয়। এই যন্ত্রের সাহায্যে এনাল ফিস্টুলার নালী আছে কিনা তা ভালোভাবে দেখে নিশ্চিত করা হয়।
- এছাড়া এমআরআই, আলট্রাসাউন্ড স্ক্যান, সিটি স্ক্যান এর মত পরীক্ষাও করা হতে পারে।
আরো পড়ুন: এনাল ফিসার কি, কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা
এনাল ফিস্টুলার চিকিৎসা-
ফিস্টুলা রোগীর জন্য প্রায় সব সময়ই সার্জারীর প্রয়োজন পড়ে। কারণ এ রোগ মেডিসিন দিয়ে কিছুটা সুস্থ হলেও অপারেশন ছাড়া কখনোই পুরোপুরি ভালো হয় না। এক্ষেত্রে যে সব সার্জারী গুলো করা হয়ে থাকে তা হল –
ফিস্টুলোটোমি: এটির মাধ্যমে মলদ্বারের নালী বা ছিদ্রের রাস্তাটি কেটে পূঁজ বের করে পরিষ্কার করা হয়। তারপর প্রয়োজন অনুসারে সেলাই অথবা সেলাই না করেও শুকাতে দেয়া হয়। সঠিকভাবে শুকিয়ে গেলে স্থানটি আগের মত স্বাভাবিক হয়ে যায়।
সেটন পদ্ধতি: এই সেটন পদ্ধতিতে কয়েক সপ্তাহ মলদ্বারের ফিস্টুলার ভেতরে সেটন নামক বিশেষ এক ধরণের সুতা প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়। সুতাগুলো ফিস্টুলা পুঁজগুলো শুষে নিয়ে স্থানটি শুকাতে সাহায্য করে। এভাবে সেটন পদ্ধতির মাধ্যমে বেশ কয়েকটি ধাপে ফিস্টুলা সম্পর্ণরূপে সুস্থ করে তোলা হয়।
অ্যাডভান্সমেন্ট এনাল ফ্ল্যাপ: এটির মাধ্যমে শরীরের অন্য যে কোন অংশ থেকে বিশেষ করে পায়ুপথের শেষ অংশ থেকে অল্প মাংস বা টিস্যু নিয়ে ফিস্টুলার রাস্তাটিতে এড করে দেয়া হয়। এ পদ্ধতিতে নতুন টিস্যু যোগ করার ফলে ফিস্টুলার অংশটিতে রক্ত চলাচল বেড়ে গিয়ে ফোঁড়া দ্রুত শুকিয়ে যায়। এর ফলে ফিস্টুলার পুরো অংশটি আর কেটে ফেলতে হয় না।
‘লিফট’ পদ্ধতি: এই পদ্ধতিতে পায়ুপথের পেশিগুলো না কেটে শুধুমাত্র ফিস্টুলাটি সরিয়ে ফেলা হয়।
এই পদ্ধতিগুলো ছাড়াও বর্তমানে ফাইব্রিন গ্লু , লেজার এ ধরণের পদ্ধতিও ফিস্টুলার নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়।
সাধারণত ফিস্টুলার সার্জারীর ক্ষেত্রে একদিনেই রোগী বাড়ী চলে যেতে পারে। তবে কিছু ক্ষেত্রে অপারেশনের পর কয়েকদিন হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন হতে পারে। ফিস্টুলার সার্জারীর প্রায় সবগুলো পদ্ধতিতে কিছু সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে। চিকিৎসক রোগীর জন্য সার্বিকভাবে উপযুক্ত পদ্ধতিটি গ্রহণ করে থাকেন।
ফিস্টুলা সার্জারীর পর সাধারণত যে ধরণের সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে –
ইনফেকশন: ফিস্টুলা সার্জারীর পর ইনফেকশন হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক খেলে তা সেরে যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে হাসপাতালে থেকে চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে।
পায়খানার চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা: প্রায় সব ধরণের ফিস্টুলার চিকিৎসায় এ সমস্যাটি হতে পারে। তবে তা বেশিদিন স্থায়ী হয় না। নিজে থেকেই এ সমস্যা সমাধান হয়ে যায়।
ফিস্টুলা পুনরায় ফিরে আসা: সার্জারী করে নিরাময় করার পরও একই স্থানে আবার ফিস্টুলা হতে পারে।